Thursday, December 5, 2024
মূলপাতানেত্রকোনার সংবাদকলমাকান্দা উপজেলাকলমাকান্দায় পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট

কলমাকান্দায় পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট

প্রান্ত সাহা বিভাস, কলমাকান্দা:
নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পাহাড়ি ছড়ার (নালা) ময়লাযুক্ত ঘোলা পানি অথবা টিলার নিচে তিন চাকের (চাক্কি) তৈরি অগভীর কুঁপের (কুয়ো বা ইন্দরা)’র ময়লা পানিই হয়ে ওঠেছে তাদের একমাত্র ভরসা। উপজেলার লেংগুরা, খারনৈ ও রংছাতি ইউনিয়নের অন্তত ৪০টি আদিবাসী গ্রামে চলছে এমন সঙ্কট।

সরজমিন তথ্যানুসন্ধানকালে আদিবাসী গ্রামগুলোর বাসিন্দারা জানান, গভীর নলক‚প না থাকার কারণেই দেখা দিয়েছে এমন সঙ্কট। তবে শুধু এবারের শুষ্ক মৌসুমেই নয়, প্রতিবারই শুষ্ক মৌসুমে এমন সঙ্কট দেখা দেয় পাহাড়ি গ্রামগুলোতে। এসব গ্রামের স্বচ্ছল পরিবারের লোকজন প্রয়োজনমতো একাধিক নলক‚প স্থাপন করে পানির সঙ্কট মেটায়। কিন্তু দিন এনে দিন খান  এমন হতদরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত পরিবারগুলোর পক্ষে তা সম্ভব হয় না। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু এক বা একাধিক বাড়িতেই না, অনেক পাড়াতেই কোনো বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অগভীর নলক‚পগুলোতে কোনো পানি উঠছেনা।

এ কারণে অনেকে দূর থেকে খাবার পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। আবার বেশিরভাগ পরিবার ব্যবহার করছে কুঁয়ো অথবা ছড়ার পানি।

কলমাকান্দা উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, তারা লেংগুরা ইউনিয়নের পাহাড়ী অঞ্চলগুলোতে বেশ কিছু গভীর কুয়ো সরকারি ভাবে তৈরী করে দিয়েছেন। তবে স্থানীয়দের দাবি অধিকাংশ কুয়ো নির্মাণের ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যেই অকেজো হয়ে পড়েছে।

রংছাতি ইউনিয়নের চন্দ্রডিঙ্গা, পাচগাঁও, সন্নাসীপাড়া, জাকিরপাড়া, মনগড়া খারনৈ ইউনিয়নের ভাষাণকুড়া, কচুগড়া, বিশ্বনাথপুর, রানীগাও, খারনৈ, গোবিন্দপুর লেংগুরা ইউনিয়নের চেংগ্নী, গোপালবাড়ী, ফুলবাড়ী, কালাপানি, কাঠাবাড়ীসহ আরো বেশকিছু গ্রামের লোকজন তাদের সঙ্কটের কথা জানাতে গিয়ে বললেন, এক সময় তারা ওপারের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা ছড়ার ময়লাযুক্ত পানিই কাপড় দিয়ে ছেঁকে কোন রকমে পরিস্কার করে পান করতেন। কিন্তু এখন ছড়াগুলোও শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। তাতে পানির কোনো প্রবাহ নেই।

এদিকে স্বচ্ছল পরিবারের লোকজন কয়েকটি বাড়িতে গভীর নলকূপ বসালেও মাত্রাতিরিক্ত আয়নের কারণেও তাও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। নিরূপায়ে অনেকে বাড়ি থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে গিয়ে ছড়ার পানি ছেকে আবার অনেকে তিনটি পাঁকা চাকায় কোন রকম একটি কুঁয়ো (ইন্দরা) তৈরি করে খাবার পানিসহ নিত্য ব্যহারের পানি সংগ্রহ করছেন।

বাতানশ্রীপাড়ার ফাতেমা হাগিদক (৬৫) বলেন, এই তিন চাকার কুয়োতে বছরের কার্তিক মাস থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ৬ মাস পানিই থাকে না, শুঁকিয়ে যায়, কারণ কুয়োগুলো গভীর নয়। এ কারণে বছরের বাকি ছ’মাস চেংগ্নী ছড়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়। তাও এক সময় ছড়ার পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফকে বলে ছড়ার উৎস মুখ জিরো লাইন থেকেও পানি সংগ্রহ করতে যেতে হয়।

সন্নাসীপাড়া গ্রামের জ্যোৎস্না রেমা অনেকটা ক্ষোভ নিয়ে নিজেদের গারো (মান্দি) ভাষায় টিলার নিচে বসেই বলেন “জ্যোৎস্না রেমা বিলছি নাম্মাচিক রিংমানজাজক’’ (অর্থাৎ) ৫০ বছরেও বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারলাম না)। চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের রাজরানী (৩২) বলেন, দিনে ২-৩বার প্রায় দেড়কিলোমিটার হেঁটে পাহাড়ের ছড়ার পাশে গর্ত করে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। এই পানি দিয়ে খাবারসহ সংসারের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে হয় আমাদের।

একই গ্রামের সুদীপ্ত হাজং বলেন, চন্দ্রডিঙ্গার আশপাশের অন্তত ৮টি গ্রামের লোকজন সীমান্তের জিরো লাইন থেকে তেলের টিন, কলসি না হয় বালতি দিয়ে ঘাড়ে বয়ে পানি আনতে হয়। তিনি আরো বলেন, কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি উদ্যোগী হয়ে কিছু টিউবওয়েল বা গভীর কুঁয়ো বসিয়ে দিতেন এ এলাকার লোকজনের বিশুদ্ধ পানির দুর্ভোগ দূর হয়ে যেত।

খারনৈ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওবায়দুল হক বলেন, আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে পানির দুর্ভোগের বিষয়টি আমরা জানি। আসলে ওখানে প্রায় হাজার ফুট গভীর নলকুপ বসাতে হবে, যা অত্যন্ত ব্যয় বহুল, মাটির নিচ থেকে পাথর সড়িয়ে যদিও বিকল্প হিসাবে গভীর কুঁয়ো বসানো যায় তাতেও ৭০ হাজার থেকে লাখ টাকা ব্যায় হয়। তিনি আরো বলেন, সরাসরি উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিলেই কেবল দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই গ্রামগুলোতে পানির সমস্যা নিরসন করা সম্ভব হবে।

কলমাকান্দা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ওই অঞ্চলগুলোতে পাথরের জন্য টিউবওয়েল বসানো সম্ভব হয় না। তবে পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে বেশকিছু রিংওয়েল বসানো হয়েছে। এখানো দশটি রিংওয়েল বসানোর কাজ চলমান রয়েছে।

কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুল হাসেমকে এ বিষয়ে সবিস্তারে জানিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি  বলেন, এটা আমার জানা ছিল না। খোঁজখবর নিয়ে আমরা অতিদ্রুত সময়ের মধ্যেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।

এই বিভাগের আরও সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সর্বশেষ সংবাদ

Recent Comments