নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
নানা তদবির তৎপরতা ও জটিলতার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বন্ধ হয়েছে অনুমোদন বিহীন নেত্রকোনার কংশ নদী থেকে অবৈধভাবে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন। শুধুমাত্র মন্ত্রণালয়ে অবেদন করেই শেখ হাসিনা বিশ^বিদ্যালয়ের নাম ভাঙ্গিয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার গত দুবছর ধরে উত্তেলন করে আসছে কয়েক কোটি ঘন মিটার বালু। যদিও নদীতে পানি কম থাকায় এই মুহূর্তে বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রকল্প পরিচালক।
জানা গেছে, গত দু’বছর ধরেই কোনরকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেই স্থানীয় প্রশাসন ও জনসাধারণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গায়েবি শক্তিতে বালু উত্তোলন চলে। নেত্রকোনা সদর উপজেলার মেদনী ইউনিয়নের বড়ওয়ারী কংশ নদীর ব্রিজের মাত্র ১৪শ ফুট উজান ও ভাটিতে এসকল ড্রেজার মেশিন বসিয়ে তোলা হয়েছে এ বালু। এতে নদী তীরবর্তী সড়কসহ চরম হুমকিতে পড়েছে প্রায় অর্ধশত গ্রামের কয়েক হাজার বাসিন্দা। এরইমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বেশ কয়েকটি কাঁচা সড়কসহ অসংখ্য আবাদযোগ্য জমি।
এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ কিংবা অভিযোগ করলেও শুধুমাত্র শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ হওয়ায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় কোন প্রতিকার পায়নি স্থানীয়রা। স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিবেশ ও জন সাধারণের ক্ষতি করে সরকার উন্নয়ন কাজ করতে বলেননি কাউকে। মাটি ভরাট বালু কিনে এনে করার কথা। কিন্তু কৃষকের জমি নষ্ট করে, বাড়ি ঘর হুমকিতে ফেলে এমন কাজ সরকার প্রশ্রয় দেয়না বলেও দাবী তাদের । বারবার কতৃপক্ষ এবং প্রশাসনের কাছে গিয়েও বাঁচাতে পারছেন না ফসলসহ ভূমি। এনিয়ে কৃষক এবং বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের সাথে মারমুখি অবস্থার সৃষ্টি হওয়ায় অবশেষে নড়েচরে বসেছে স্থানীয় প্রশাসন।
কৃষকরা জানায়, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন প্রক্রিয়ায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি খালের স্বাভাবিক গতিপথ। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে আশপাশের বেশকটি বিলে আবাদকৃত অন্তত ১৫০ হেক্টর জমির বোরো ফসল। জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন সড়কে। যে কারনে বসতবাড়িতে চলাচল অনেকটাই ভোগান্তিতে পরতে হয় স্থানীয়দের। সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ব বিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণে ৫ শ একর ভূমি ভরাটে কংশ নদীতে ৬৪ কোটি ৪২ লাখ ৭শ ৯২.৯০০ ঘন মিটার বালু উত্তোলনের অনুমোদন চেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার।
২০১৯ সনের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২০২২ সালের ২২ জুন চেকলিষ্ট অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ অবাণিজ্যিক ভাবে বালু ও মাটি উত্তোলনের প্রস্তাবনা দেয়ার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালককে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু অদ্যবধি পর্যন্ত বেশ কয়েকবার তাগাদা দেওয়া হলেও কর্তৃপক্ষ কোনরকম অনুমোদন ছাড়াই নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে কংশ নদী থেকে বিপুল পরিমাণ বালু উত্তোলন করেছেন।
নীতিমালায় উল্লেখ আছে ভূত্বাত্তিক জরিপে বালু মহাল ঘোষণার পর নিয়ম অনুযায়ী তুলতে হবে বালু। কিন্তু কংশ নদীতে এসকল কোন কিছুরই তোয়াক্কা না করে মন্ত্রণালয়ে জবাব না দিয়ে গায়েবি শক্তিতে তোলা হয় বালু। যা পরিবেশ ও আশপাশের গ্রাম বাড়িঘরের জন্য চরম হুমকী।
এ নিয়ে একাধিকবার জেলা প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা দিলেও কর্ণপাত করেনি স্থানীয় প্রভাবশালী ঠিকাদারি অংশীদারেরা। এতে নদী ভাঙ্গনের কবলে হুমকিতে পড়েছে তীরবর্তী বেশ কিছু গ্রাম। নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে কাঁচা সড়ক। বালু আনতে খাল ভরাট করে অপরিকল্পিত বাঁধের ফলে হুমকিতে পড়ে ফসলি জমি। ক্ষুব্ধ হন কৃষকসহ ক্ষতিগ্রস্থরা। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি স্থানীয়দের অভিযোগের প্রেক্ষিতে জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যবস্থা নিতে গেলেও জনপ্রতিনিধি সহ জনসাধারণের উপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, পিআরওসহ সংস্লিষ্ট কতৃপক্ষের অসৌজন্যমূলক আচরণের সম্মুখীন হয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে নানা জটিলতা কাটিয়ে সাময়িক সমস্যার সমাধান হলেও আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রী পরিষদ সচিব ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ জানিয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এরপর থেকেই নড়েচড়ে বসেছে প্রকল্প পরিচালক, বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহ ঠিকাদাররা। ফলে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বন্ধ রয়েছে অবৈধ বালু উত্তোলন প্রক্রিয়া। যদিও কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই গায়েবি শক্তিতে গত দুবছরে কয়েক কোটি ঘন মিটার বালু উত্তোলন করে ফেলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনুমোদন বিহীনভাবে দুবছর ধরে বালু তোলার বিষয়ে ঠিকাদার আওযামীলীগ নেতা গাজী মোজম্মেল হোসেন টুকু জানান, স্থানীয় প্রশাসনের নজরে রেখেই বালু তোলা শুরু করেছিলেন। এখন গত দুইদিন আগে বিআই ডব্লিউ টিয়ের সার্ভে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রকল্প পরিচালক আনিস মাহমুদ জানান, নদীতে পানি কম থাকায় এই মুহূর্তে বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। বিশাল এই প্রজেক্টের কাজ করতে জলাবদ্ধতা সহ ছোটখাটো কিছু সমস্যা হচ্ছে। সেগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং সমাধানেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে বালু উত্তোলনের অনুমোদনের জন্য আবেদন দেয়া হয়েছে অনেক আগেই। তবে বেশকিছু দপ্তর জড়িত থাকায় অনুমোদনের বিষয়টি কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এদিকে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ, জানান দীর্ঘদিনের অবৈধ পন্থায় বালু উত্তোলন বন্ধ ও খাল ভরাটের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। এই মুহূর্তে বালু তোলায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।