স্বপন পাল:
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় প্রথম কোথায় পড়েছেন এ প্রিয় এই লাইন দু’টো, আমি নিশ্চিত অধিকাংশরই উত্তর হবে দেয়ালে। সত্তর, আশি এবং নব্বই, -তুমুল এই তিন দশকের তো ছিলই, এখনো কিংবা বলা যায় চিরকালের যৌবনের হিরন্ময় উচ্চারণ এই লাইন দু’টো। একসময় শহরের দেয়ালে দেয়ালে ‘চিকামারা’ হয়েছে কবিতার এই দু’টি লাইন। এখনো যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কবি হেলাল হাফিজের কালজয়ী এই লাইন দু’টো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা, প্রকাশনায় ‘ব্যানারপোস্ট’ করা হয়। ‘নিউট্রন বোমা বোঝো,
মানুষ বোঝো না’। দু’লাইনের ছয় শব্দের মধ্যে দিয়ে মানবিক এক পৃথিবীর এমন ঘোষণা আর কোনো কবি দিয়েছেন কিনা জানিনা! সরাসরি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে কখনো যুক্ত ছিলেননা, কিন্তু ছিলেন প্রচ-ভাবে রাজনৈতিক সচেতন। তাই তো অসংস্কৃত রাজনীতির বিরুদ্ধে এভাবেই বলতে পারেন তিনি, ‘ভোলায়া ভালায়া আর কথা দিয়া কতোদিন ঠাগাইবেন মানুষ ভাবছেন অহনো তাদের অয় নাই হুঁশ।… রাইত অইলে অমুক ভবনে বেশ আনাগোনা, খুব কানাকানি, আমিও গ্রামের পোলা চুতমারানি গাইল দিতে জানি।’
হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার আর মা কোকিলা বেগম। নেত্রকোনা শহরেই কেটেছে কবির শৈশব, কৈশোর ও প্রথম যৌবন। শৈশবে মাকে হারানো হেলাল হাফিজ আশ্চর্য এক বেদনাবোধ নিয়ে বেড়ে উঠেছেন। এই বেদনাবোধ থেকেই হয়ত তাঁর মাঝে কবিতার জন্ম।
১৯৬৫ সালে নেত্রকোনা দত্ত উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন হেলাল হাফিজ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। সে রাতে ফজলুল হক হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পড়ে সেখানেই থেকে যান। রাতে নিজের হল ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক) থাকার কথা ছিল। সেখানে থাকলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতা শুরু করেন হেলাল হাফিজ। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক, ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।
১৭ বছর লেখালেখির পর ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় হেলাল হাফিজের প্রথম ও সাড়া জাগানো কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। সেই বইয়ের ৫৬টি কবিতা দিয়ে কবি বাংলা কবিতার জগতে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছতে সমর্থ হন। একটি মাত্র বইয়ের মাধ্যমে কাব্য সাম্রাজ্যে রাজত্ব করে আসা কবির কপালে বিরলপ্রজ তকমা জোটে।