প্রতি বছর হাওরের ফসল রক্ষায় কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে বেরিবাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু প্রতিবারই পাহাড়ি ঢলে বেরিবাঁধ ভেঙ্গে ফসল হানির ঘটনা ঘটে। শুরু হয় কৃষকদের আহাজারী। এবারই প্রথম গত ৮ দিন ধরে পানির সাথে যুদ্ধ করে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামত করেও ক্লান্ত হয়ে কাটছে অধাপাকা ধান। অন্যদিকে গত দুদিন ধরে স্থানীয় প্রশাসন টাকার বিনিময়ে শ্রমিক দিয়ে করাচ্ছেন বাঁধের কাজ। কিন্তু জলমহালে মাছ আহরণে পানি আটকে রাখায় বিলম্বিত বাঁধের কাজে এমন দুর্ভোগ প্রতিবারের। এছাড়াও পিআইসির বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নেত্রকোনা জেলার হাওরাঞ্চল খালিয়াজুরী উপজেলার প্রতিটি মানুষ কৃষক। যাদের একমাত্র ফসল বোরো ধান। জেলার ১৩৪ টি হাওরের মধ্যে খালিয়াজুরীতেই ৮৯ টি হাওর থাকায় মাছের অভয়ারণ্য বলা যায় এলাকাটিকে। যার ফলে প্রতিবছর জলমহাল ইজারা নিয়ে কোটি কোটি টাকার মাছ আহরণ করে প্রভাবশালীরা। এদিকে কৃষকদের একমাত্র ফসল রক্ষায় শুকনো মৌসুমে ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এবছরও খালিয়াজুরীতে ৮৮ টি পিআইসির মাধ্যমে প্রায় ৮১ টি কিলোমিটার ডুবন্ত বাঁধের জন্য মোট বরাদ্দ ছিলো ১৬ কোটি টাকা। ৫৫ কিলোমিটার বেরিবাঁধের সাত কিলোমিটার কির্ত্তণখোলার বিভন্ন পয়েন্টে দুইটি ফোল্ডারে চারটি পি আইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) মাধ্যমে প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যায় হয়েছে। তারমধ্যে ২ নং ফেল্ডারের ৬ নং পি আইসি কতৃৃক ২৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকায় একটি অংশ মেরামত হয়। কিন্তু এই অংশটিই বারবারই ঝুঁকিপূর্ন থাকে।
গত ২ এপ্রিল থেকে পাহাড়ি ঢলে ধসে যায় কীর্ত্তণখোলা বাঁধের অংশটি। আর তখন থেকে মেরামতে জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধে নামেন শতশত কৃষক। দিনরাত খেটে বাঁধ মেরামত শেষে সকালেই দেখে আবার ফ্টাল। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে আধাপাকা ধান কাটতে শুরু করেছেন তারা। এতে করে কিছু হলেও যাতে ঘরে তুলতে পারেন। অন্যদিকে বাধ্য হয়ে শেষে স্থানীয় প্রশাসন টাকার বিনিময়ে বাঁধ মেরামত করাচ্ছেন শ্রমিক দিয়ে। ৫ নং ওয়ার্ড মেম্বার শ্রী চরণ সরকার বলেন, কৃষকরা ধান কাটবে না বাঁধ মেরামত করবে? তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমাকে ইউএনও অনুরোধ করায় আমি ¤্রমিক দিয়ে কাজ করাচ্ছি। আমি কোন পিআইসিও না কিচু না।
ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি রাজ মিয়া বলেন, এলাকায় সাজ্জাত সাহেব ও এমপি রেবেকা মমিন আছেন। তারা নিজেদের বাড়ির এলাকার কাজ নিয়েই ব্যাস্ত। আমরা খালিয়াজুরীর আওয়ামীলীগ জীবন দিয়ে দিলেও তারা আমাদের কৃষকদের কথা ভাবেন না। বারবার বাঁধ ভাঙ্গে তাদের কোন ভ্রক্ষেপও নাই। আজ এই এলাকার এবং জনগণের নেতা থাকলে বুঝতো আমাদের কৃষকদের আহাজারি। তারা বুঝবে না।
এদিকে ধান কাটা ও বাঁেধে ব্যাস্ত কৃষকদের অভিযোগ অগ্রাহায়ণ পৌষ মাসে কাজ শুরুর কথা থাকলেও কাজ শুরু হয় ফাল্গুন চৈত্রতে যখন জোয়ার আসে। তার উপর বাঁধের দুইপাশ থেকে মাটি তোলে। অন্যদিকে জলমাহলে পানি আটকে রাখায় কম সময়ে বিলের উপর বাঁধটি করার ফলে নরম থাকে। জোয়ারের ঢলই ভেঙ্গে যায়। এর উপরে রয়েছে পি আইসির বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ না করা। নামে মাত্র মাটি কাটার ফলে এমন ঘটনা ঘটে।
এ ব্যাপারে বাঁধের ২ নং ফোল্ডারের ৬ নং পিআইসি সভাপতি নেহার রঞ্জন দেব বলেন, পানির জন্য কাজ শুরু করতে হয়েছে তাদের জানুয়ারীতে। জলমালের কুড় আর বিলের উপর বাঁধটি। যে টাকায় কাজ করা হয়েছে তার থেকে খরচ বেশি হয়েছে বলেও দাবী করেন তিনি। তবে তিনি বাঁধের কাছ থেকে মাটি তোলার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন বাঁধের দুই পাশে গভীর থাকার কারণেই ধ্বস। নভেম্বরের কাজ কেন ফেব্রুয়ারিতে শুরু করা হলো এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড তখন স্লুইসগেট খুলে পানি ছাড়েনি। ফলে দেরি হয়েছে। এটি আমাদের দোষ না। তবে জানুয়ারীতে কাজ শুরু করে ফেব্রুয়ারী শেষ করেছেন বলে তিনি দাবী করেন। এখন পিআইসির অর্থায়নে টাকা দিয়ে শ্রমিক এনে বাঁধ মেরামত করছেন।
এদিকে জেলা প্রশাসক কাজি মো. আবদুর রহমান জলমহালের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এবারই তিনি বড় একটি ত্রুটি লক্ষ্য করেছেন। বাঁধের গভীরতা ও সময়ে ভরাট করতে বাঁধাসহ কিছু সমস্যা সামনে আসায় এটিকে নিয়ে সবাইকে রেখে সরকারের রাজ্স্ব ঠিক রেখে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হবে আগামীতে। এছাড়াও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্যাকনিক্যাল প্রি মেজারমেন্ট কিভাবে করে এটিও একটি বিষয়।