পরিস্কারের নামে চলছে লেখক হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের বিখ্যাত মোহনগঞ্জের শিয়ালজানি খালের স্লাব লুটপাট। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পৌরশহররের ঠিক মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া শিয়ালজানি খালের পলি পরিষ্কার করতে গিয়ে পলির সাথে মিশে থাকা হাজার হাজার সিমেন্টের স্লাব পলিমাটির দামে বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ ওঠে। পৌরশহরের দৌলতপুর গ্রামের এক শিক্ষক তার পুকুর ভরাট করছেন এই খালের মাটি কিনে।
সেখানে মাটির সাথে মিশে আসছে অসংখ্য স্লাব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষক বলেন, তিনশত পঞ্চাশ টাকা প্রতি লরি দরে মাটি কিনে পুকুরটা ভরাট করছি। আমি তাদেরকে শুধু মাটি দিতে বলেছি। কিন্তু এখন দেখছি প্রচুর স্লাব চলে আসছে। তাদেরকে বলেছি এসব স্লাব তারা নিয়ে যায় যেনো। স্থানীয়দের অভিযোগ, কাজটা যেই বাস্তবায়ন করুক না কেন এসব স্লাব আমাদের শিয়ালজানি খালের। এগুলোকে মাটির সাথে বিক্রি করে দেয়াটা দিনেদুপুরে ডাকাতি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মোহনগঞ্জ পৌরসভার তত্ত্বাবধানে শিয়ালজানি খালের পলি অপসারণ কাজের টেন্ডার হয় ২৪ লক্ষ টাকায়। কাজটি পান নেত্রকোনার মেসার্স মামুন কন্সট্রাকশন নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ ব্যাপারে ঠিকাদার মামুন আহমেদ জানায়, নেত্রকোনা থেকে গিয়ে নিয়মতি কাজের দেখভাল করতে কষ্ট হয় বিধায় আমার আত্মীয় সুজাতকে দায়িত্ব দিয়েছি। সে নাহিদ নামে সেখানকার তার এক বন্ধুকে নিয়ে কাজটি তরারকি করছে।
তবে পাউবো’র একটি সূত্র ও স্থানীয় কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, পলি অপসারণের কাজটি টেন্ডারে নেত্রকোনার মামুন আহমেদ পেলেও পৌরমেয়র লতিফুর রহমান রতন এটিকে ম্যানেজ করে এনে দিয়েছেন তার ভাগ্নে পৌরসভার সহকারি কর আদায়কারি আসিফুর রহমান শুভকে। শুভ তার বন্ধু ছাত্রদল নেতা নাহিদকে নিয়ে কাজটি বাস্তবায়ন করছেন। নিয়মিত খালের কাজের তদারকি করতেও দেখা গেছে তাদেরকে। তবে আসিফুর রহমান শুভ এ কাজে তার সম্পৃক্ততার বিষয় অস্বীকার করে বলেন, কাজ পেয়েছে নেত্রকোনার একজন। আর এটি তদারকি করছে নাহিদ। এখানে সুজাত নামের কাউকে তিনি চিনেন না বলেও জানান।
এ বিষয়ে মোহনগঞ্জ পৌরসভার প্রকৌশলী শামীম আহমেদ বলেন, কিছু স্লাব মাটির সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে, আলাদা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই এগুলো মাটির সাথে চলে যাচ্ছে। তবে এর পরিমাণ খুব বেশি নয়। এ প্রকল্পের বড় অংশের বাস্তবায়নকারি প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। খালের স্লাব বসানোর কাজটিও করেছেন তারা।
তবে পাউবো’র উপজেলা কর্মকর্তা মো. সোহাগ ফকির বলেন, পলির সাথে স্লাব চলে যাচ্ছে এমন তথ্য তার জানা নেই। তবে পাউবো’র উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী অমিতাব চৌধুরী বলেন, বিষয়টি তিনি অবগত হয়েছেন। তবে পরিষ্কারের কাজটি যারা করছেন তারা শুধু ময়লাটা অপসারণ করবে। স্লাবগুলো তো মাটি থেকে আলাদা করে পাড়ে তুলে রাখবে। এভাবে পাইকারি দরে সব স্লাব তুলে ফেলে দেয়াটা ঠিক নয় বলে তিনি জানান।
কাজের সাথে নিজের ভাগ্নে জড়িত নেই দাবি করেন পৌর মেয়র লতিফুর রহমান রতন। তিনি বলেন, ওই কাজটা ই-টেন্ডার দেয়া হয়েছিল। লটারির মাধ্যমে নেত্রকোনার মামুন নামে একজন পেয়েছে। ওই ঠিকাদারই কাজটা করছে। স্লাবের বিষয়ে তিনি বলেন, বেহিসেবি প্রচুর পরিমাণে স্লাব বানিয়ে পাউবো কর্মকর্তারা তাদের নিজেদের ব্যর্থতা লুকাতে অতিরিক্ত স্লাব খালের পানিতে ফেলে দেয়। এখন যারা পলি পরিষ্কার করছে তারা এসব স্লাব কোথায় নিয়ে রাখবে। তাই তারা যতটুকু সম্ভব আলাদা করে রাখছে। বাকিগুলো পলির সাথে ফেলে দিচ্ছে। খাল জুড়ে ৩০-৪০ হাজার স্লাব হবে বলেও তিনি অনুমান করেন।
এ বিষয়ে ইউএনও আরিফুজ্জামান বলেন, বিষয়টি অবগত হয়েছি। পৌর মেয়র ও পাউবো কর্মকর্তাদের নিয়ে আলোচনা করে বিষয়টি সুরাহা করা হবে। উল্লেখ পৌরশহরকে দ্বিখণ্ডিত করে কংশ নদীতে গিয়ে মিশেছে শিয়ালজানি খাল। প্রথম শ্রেণির এ পৌরশহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া শুরুত্বপূর্ণ খালটি প্রভাবশালীদের দখলে দাপটে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাত থেকে এটিকে উদ্ধার করে সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্যোগ নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব-১ বর্তমানে বাংলাদেশ পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এলাকার সন্তান সাজ্জাদুল হাসান। পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য রেবেকা মমিন ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসান যৌথভাবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। এই প্রকল্পে মোট ব্যয় হয় ২৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা প্রায়। এতে খালটি পুনঃখনন করে পৌরশহরের গরুহাট্টা এলাকা থেকে মাইলোড়া পর্যন্ত শিয়ালজানিতে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ,
শিয়ালজানির দু’পাড় স্লাব বাঁধাইয়ের মাধ্যমে সংরক্ষণ এবং টাইলস সমৃদ্ধ ওয়াকওয়ে নির্মাণ, টয়লেট নির্মাণ, রাতে চলাচলের জন্য ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন। ফলে এটি এখন স্থানীয়দের কাছে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও মোহনগঞ্জ পৌরসভা যৌথভাবে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিলো।