দুর থেকে দেখা যাবে আগুনের লেলিহান শিখা। লালচে বর্ন ধারণ করে পুড়াচ্ছে কয়লা। তার উপরে সেদ্ধ হচ্ছে চালের গুড়া। বাড়ি থেকে প্রক্রিয়া করে চালের গুড়া নিয়ে আসেন জালাল উদ্দিন ও তার জীবনসাথী মোর্শেদা। এরপর প্রতিদিন আপন মনে আগুনের তাপে ভাজতে থাকেন চিতই পিঠা আর ভাপা পিঠা। ধোঁয়া উঠা পিঠা খেতে ভিড় জমান নানা বয়সী মানুষেরা। পথ দিয়ে যেতে যেতে আমাদের চোখেও পড়লো এমন দৃশ্য। আগুনের দিকে তাকাতেই চোখ যেনো আটকে গেল। কাছে গিয়ে দেখা গেল দুজনই একসাথে পিঠা নামাচ্ছেন আর বাড়িয়ে ধরা হাতগুলোতে তুলে দিচ্ছেন। সরিষার ভর্তা আর চেপা ভর্তায় ঝালের একটি শু-শা শব্দে চলে পিঠা খাওয়া।
আমরা তিনজন। আমরাও গিয়ে বাড়িয়ে দিলাম তিনটি হাত। অপেক্ষায় থাকতে হবে গরম গরম খাওয়ার জন্য। পিঠা নামতে যতক্ষণ সময় ঠিক ততক্ষন সময় আলাপ চারিতায় তাদেরকে যুক্ত করলাম। কুশলাদি জিগ্যেস করছি। কিন্তু আগুনের উপর থেকে কোনভাবেই তাদেও নজর সরানো যায়নি।
এরমধ্যে আমাদের হাতেও পিঠা চলে আসলো। ততক্ষণে আমিও জেনে গেলাম চার সন্তানের এই জনক জননি পিঠা বিক্রি করে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরে। এটিই সংসারের মূল উপার্জন। তবে করোনার প্রভাবে এই উপার্জনেও যেনো বাধা।
নাগড়া এলাকার একটি কোচিং সেন্টারের সামনের মোড়ে তারা দোকানটি দাড় করিয়ে রেখেছেন। দোকান একটি ভ্যানগাড়ি। যার মধ্যে দাউ দাউ করে জলছে সাতটি মাটির চুলা। চুলার উপওে বসানো একটি ভাপা পিঠার বড় সসমেন। বাকিগুলো চিতই পিঠার হাড়ি। প্রতিদিন বিকাল থেকে রাত অবধি চলে পিঠা বিক্রি। একসময় চার থেকে পাঁচশ পিঠা বিক্রি হতো। প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার টাকা আয় হতো। আর এ থেকে নিজেদের জন্য হাজেরখানেক টাকা খরচ বাদে থাকতো। যা দিয়ে সুন্দর ভাবে চলে যেতো সংসারটা। কিন্তু এর মাঝে করোনার ছুবলে বার বার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আয়ও কমে গেছে। সন্ধ্যা থেকে এখন রাত পর্যন্ত দুই থেকে আড়াইশ পিঠা বিক্রি করা যায়। এতে খরচ বাদে তিন চারশ টাকা থাকে। যা দিয়ে চার সন্তানের মাঝে নারগিসকে পড়াচ্ছে স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে নারগিস। সবার বড় মেয়ে বিলকিসের বিয়ে দেন সাতপাই গাড়া এলাকায়।
বিলকিসের স্বামী রিক্সা চালক। মেঝোটা বড় ছেলে সে থাকে ঢাকায় একটি গার্মেন্টেসে। ছোট ছেলে সবার ছোট তাই এখনো স্কুলে দেয়া হয় নি। জুনাইদ ও মোস্তফা নামের দুই ছেলে প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের যেনো সুখের সীমা থাকবে না।
এই পিঠা দম্পতির চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ বিারাজ করছিলো। গল্প জমে উঠলে বলছিলো কাউকে ঠকিয়ে নয়, তারা মানুষের মাঝে তৃপ্তির রেশ দিয়ে সংসার চালান। তাদেরও ভালো লাগে। কেউ কেউ একবার খেয়ে আবার নেন। কেউবা পরদিন বন্ধুদের নিয়ে আসেন। তারা নিজ কর্ম দিয়ে নিজেরা এবং সন্তানদের চলতে শিখাচ্ছেন। অট্টালিকার প্রয়োজন নেই। দুজনের গ্রামের বাড়ি পাশাপাশি। জেলার কলমাকন্দা উপজেলার সীমান্ত পাহাড়ি নদী মহাদেও এর পাশে জালাল উদ্দিনের বাড়ি। জালাল উদ্দিনের বাড়ির পাশেই স্ত্রী মোর্শেদার নানার বাড়ি। সেখান থেকেই দুজনের কাছাকাছি। তারা মনে করেন অন্য দুই সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলতে পারলেই বাকী জীবন স¦ার্থক। আগে বুঝতে পারেননি যে পড়াশুনো খুব প্রয়োজন। আর বুঝলেও তাদেরকে পড়ানোর ক্ষমতা ছিলো না।