দফায় দফায় ঢল আর বৃষ্টির পানিতে এবার নেত্রকোনায় রোপা আমন আবাদে বিঘ্ন ঘটলেও অবশেষে ধান ঘরে তুলতে শুরু করেছে নেত্রকোনা জেলার কৃষান-কৃষানী। তবে খুশি নেই কারোরই মুখে।
কৃষি বিভাগের মতে ফলন ভালো হলেও অসন্তোষ জানায় প্রান্তিক কৃষকরা।
শ্রমিকের কাজ নিজেরা করেও এবার লাভের আশা গুড়েবালি।
কৃষি বিভাগের সঠিক তদারকি থাকলে কম ক্ষতি হতো বলে অভিযোগ কৃষকের।
এদিকে কৃষির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন নিন্মচাপে কিছুটা ক্ষতি হলেও নতুন জাতের উচ্চ ফলনশীল জাতে সেই ক্ষতি পুষিয়ে যাবে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ধানে উদ্বৃত্ত জেলা নেত্রকোনার সর্বত্র শুরু হয়েছে ধান কাটা উৎসব।
জেলার হাওরাঞ্চল বাদে সবকটি উপজেলায় চলছে রোপা আমন ফসল কর্তন মাড়াই। বড় কৃষকরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে কর্তন করছেন ধান। এতে শ্রমিক খরচ কমের পাশাপাশি সময় সাশ্রয় হচ্ছে।
সেইসাথে আলাদা খরচ হচ্ছেনা ধান মাড়াইয়ে। সরাসরি ব্যবসায়ীদের হাতে মাঠ থেকেই তুলে দিচ্ছে ধান।
কিন্তু পোকার আক্রমণের শিকার হওয়া কৃষকের মনে নেই খুশি।
দফায় দফায় ঢলের পানি আর অতিবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা নিরানন্দে।
ঘরের খাবার জোগানে কোন রকমে চলবে অনেকের। তবে অনেক কৃষান-কৃষাণীর মাথায় হাত।
ধানে পোকাসহ ধান গাছ পড়ে যাওয়ায় ধান কাটার মেশিন চলে না অনেক জমিতে।
সদর উপজেলার বালি এলাকার কৃষাণী ফাতেমা বেগমের ২৮ কাঠা জমি আবাদে ক্ষতি হয়েছে ৫০ হাজার টাকা।
এদিকে কৃষি উপকরণ হারভেস্টার মেশিনে উঁচু স্থানের ফসল ভালোভাবে কাটতে পারলেও হেলে পড়ে যাওয়া এবং নীচু কাঁদা এলকার কৃষকরা পড়েছেন বিপাকে।
শ্রমিক দিয়েও কাটাতে না পেরে ফসল ঘরে তুলতে নিজেরাই কাটছেন ধান।
পুকুরিয়া এলাকার কৃষক বজলুর রহমান বাবুল অভিযোগ করেন কৃষি বিভাগের মাঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
তিনি বলেন, কৃষি অফিসাররা বসে বসে বেতন নেন। একে তো দফায় দফায় পানিতে নষ্ট হয়েছে ফসল।
অন্যদিকে পোকার আক্রমণে ক্ষতি হয়েছে। সবখানে সমান তদারকি করে সঠিক পরামর্শ দিলে হয়তো ফলন খারাপ হতো না। এইবার ফসল যা হয়েছে সবটাই ক্ষতি। ইঁদুরেও করে ক্ষতি।
পোকার বিষয়ে কৃষি বিভাগ পরামর্শ দিলে হয়তো এতো ক্ষতি হতো না।
সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের বালি গ্রামের ফাতেমা বেগম বলেন, এবার ২৮ কাঠা জমিতে আবাদ করেছেন। ১৬ হাজার টাকার শুধু সারই দিয়েছেন।
হাল খরচ দিয়েছেন ১০ হাজার টাকার। কামলা খরচ সহ প্রায় ৫০ হাজার টাকার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তিনি। ৯ থেকে ১০ কাঠার মতো কাটা হয়েছে। কিন্তু ধান হয়নি। এবার বিক্রি করা যাবে না। শুধু খাওয়া আর গরুর খড় হবে। এদিকে সাইদুল ইসলাম নামের কৃষক বলেন, ১২ কাঠা জমিতে আবাদ করেছিলেন।
দফায় দফায় করেও প্রায় ৮ কাঠা জমির ধান পানিতে নষ্টই হয়ে পড়েছে। থোরে পানি লাগায় পঁচে গেছে। ধান হয়নি। নিজেরা কেটেও খরচ তুলতে পারবো না। কামলা খরচ দিয়েছি সাড়ে তিনশ করে। কাঠা প্রতি হালে। চারা রোপণে। এগুলো সবই মাইর গেছে।
বাকি ৪ কাঠার মতো কেটেছি এতে ৬ থেকে ৭ মণের মতো ধান হয়েছে।
হারভেস্টার মেশিন চালক জাবেদ আলী জানান, পানি না থাকলে সেগুলো কাটা যায় অনায়াসে। কম সময়ে কম খরচে সাশ্রয়ী।
দেড় ঘন্টা সময়ে এক একর জমিতে তেল লাগে সর্বোচ্চ ৮ লিটার। সাথে আরও দুজন নিয়েছি।
এদের নিয়ে কাজ করলে দেখা গেছে সারদিনে চার থেকে পাঁচ একর জমি কাটা যায়।
এতে পয়ঁত্রিশ শত থেকে চার হাজার টাকা সেইভ হয় ১০ একরে। আবার ধানের মাড়াই হয়ে পড়ে। কিছু জমি শুয়ে পড়ায় কাটা যায় না।
সাড়ে পাঁচশ ছয়শ টাকায় কেটেও নুয়ে পড়াগুলো পুষায় না। সময় বেশি লাগে। তাই হয়তো কৃষকরা সেগুলো নিজেরাই কাটেন।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এবছর রোপা আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিলো এক লাখ ৩২ হাজার ৫৮০ হেক্টর।
কিন্তু অর্জিত হয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৯০ হেক্টর জমি।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে ধান কাটা উৎসব।
ডিসেম্বর ২ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ৬৫ ভাগ ধান কর্তন হয়েছে। ফলনে হাইব্রিড প্রতি হেক্টরে ৪ মেট্রকটন ও উপসী প্রতি হেক্টরে ৩ মেট্রিক টন আনুমানিক ধান আসবে বলে কর্তন নমুনায় জানা গেছে বলেও জানান কৃষি বিভাগ।
নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলছেন, এবার নানা দুর্যোগে ক্ষতি হলেও কৃষি উপকরন সার বীজ দেয়ায় তেমন ক্ষতি হয়নি।
লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ১০ হেক্টর আবাদ বেশি হয়েছে। এখানে হাইব্রিডের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৯ হাজার।
অর্জন হয়েছে ৩ হাজার ৬৮০ হেক্টর বেশি। উপকরণ সার এবং বীজ প্রাপ্তিতে কোন সমস্যা ছিলো না।
মাঝামাঝিতে বৃষ্টির কারনে ফলন ভালো হয়েছে। রোগ পোকার আক্রমণ কম ছিলো। ফসলের মাঠ পর্যায়ের অবস্থা অনেক ভালো।
ধান কেটে নমুনা শস্য কর্তনে যে ফলন পাওয়া যাচ্ছে তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি আছে। নতুন যে জাতগুলো আছে সেগুলো বেশ উচ্চ ফলনশীল। যেমন ব্রি-ধান ৭৫, ৮৭, বিনা ১৭ এই জাতগুলো
মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের চেষ্টা করছি। আবাদও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে হিসাবে এবার চালের যে টার্গেট ছিলো ৩ লাখ নব্বই হাজার ৩২২ মেট্রিকটন, মনে হচ্ছে আমাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চাল উৎপাদন বেশি হবে।
অক্টোবর মাসে নিন্ম চাপের কারণে কিছু কিছু এলাকায় ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছে। এর পরেও হাইব্রিড আবাদে সার ঠিক দেয়া এবং উচ্চ ফলনশীল আবাদ বেশি হয়েছে।
এছাড়া আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে সাম্প্রতিককালে যে জাতগুলো যুক্ত করা হয়েছে, সে জাতগুলো আবাদ করার ফলে ফলন বেশি হয়েছে।
কৃষি বিভাগ মনে করে পুরাতন জাতের পরিবর্তে নতুন জাত আবাদ করলে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো সেটি পূরণ করতে সম্ভব হবে।