ফয়েজ আহম্মদ হৃদয়, মদন: ৩৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ২০ কাটা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। জমি থেকে এক ছটাক ধান ঘরে তোলার আশা নেই। ঘরে খাবারও নেই। আত্মীয়র বাড়ি থেকে ১০ কেজি চাউল দিয়েছিল আর মাত্র একদিন চলবে। দোকানে গিয়ে ছিলাম কিছু বাজার করতে দোকানদার বাকী দিতে রাজি হয়নি। সে বলেছে জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে খেতে পাবে না, এখন তোমাকে বাকী দিলে পরে টাকা কোথায় থেকে দিবা। চার মেয়ে দুই ছেলে আমার। ঘরে গিয়ে সন্তানের মুখের দিকে তাকালে কান্নায় বুখ পেটে যায়। তাদের কি খাওয়াবো? কি দিয়ে করবো তাদের বরণ-পোষন? আর কি দিয়েই করবো ঋণ পরিশোধ। বয়স হয়েছে,শরীরে শক্তি নেই। হাওরের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অন্যর বাড়িতে কাজ করারও কোনো সুযোগ নেই। দু-চোখে অন্ধকার দেখছি। আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই আমার।
হাওরের জমিতে বসে এসব কথা বলে বিলাপ করে কান্না করছিলেন মদন উপজেলার গোবিন্দ্রশ্রী গ্রামের কৃষক আবুল মিয়া। শুধু সে নয় তার মতো হাজার হাজার কৃষকের কান্নায় ভারী হয়ে যাচ্ছে নেত্রকোনার মদন উপজেলার হাওরাঞ্চল। তাদের মাঝে শুরু হয়েছে হাহাকার।
গত রবিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ দমকা গরম বাতাস। তিন থেকে চার ঘণ্টা স্থায়ী বাতাসে স্থানীয়দের মাঝে শুরু হয় এক ধরণের আতংক। গভীর রাতে বাতাস কমার পর আতংক কমে গেলেও সকালে উঠে কৃষকের মাথায় হাত। সূর্য্যরে প্রকরতা বাড়ার সাথে সাথে উঠতি বোরো ফসলের ধানের শীষ মরতে শুরু করে ক্ষেতের পর ক্ষেত, মাঠের পর মাঠ।
হাওরে ২৮ জাতের ধানসহ কাটা শুরু হয়েছে বিভিন্ন জাতের হাইব্রিড ধান। বেশির ভাগ জমির ধানই পাকতে শুরু করেছিলো। এই সময়ে হাওর পাড়ের কৃষক-কৃষাণীরা কষ্টে ফলানোর সোনার ফসল ঘরে তুলতে অনেকেই ব্যস্থ সময় পার করতেন। কিন্তু এ বছর তাদের মাঝে শুরু হয়েছে শুধু হাহাকার।
এদিকে ফসলের এমন ক্ষতির কারণ জানতে কৃষি বিভাগের একটি গবেষক দল মাঠে কাজ করছেন। হাওরের বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ শুনে বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু মঙ্গলবার বিকাল ৪ টার দিকে মদন উপজেলার কয়েকটি হাওর পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের সরকার কর্তৃক সব ধরণের সহযোগীতার আশ্বাস দিয়ে বলেন, কয়েক মিনিটের গরম বাতাসে হাওরের এমন দূর্যোগ বয়স্ক লোকেরাও দেখেনি বা শুনেওনি। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। ক্ষতিগ্রস্থদের পাশে থাকবে সরকার। লগডাউনের পর আমি ঢাকা গিয়ে কৃষি মন্ত্রীর সাথে সরাসরি কথা বলবো।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হাবিবুর রহমান মদন উপজেলার বিভিন্ন হাওর পরিদর্শন করে বলেন, অতি গরম আবহাওয়ায় এমনটা হয়েছে। ফুল আসা ধান সব চিটা হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে আছে, জরিপ শেষে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে। হঠাৎ গরম বাতাসে বোরো ফসল নষ্ট হওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য কৃষি বিভাগের একটি গবেষণা ইউনিট মাঠে কাজ করছে।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, চলতি বোরো মৌসুমে পৌরসভাসহ উপজেলার ৮ ইউনিয়নে এবার ১৭ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। তাদের তথ্যমতে প্রায় ৫০ ভাগ জমির ধানেই নষ্ট হয়ে গেছ কিন্তু কৃষকদের মতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশী। পুরো হাওরের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরূপন করতে আরো সময় লাগবে বলে জানান কৃষি বিভাগের লোকজন।